বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ঝুঁকি রয়েছে : টিআইবি

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ঝুঁকি রয়েছে : টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, দেশের অধস্তন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ঝুঁকি রয়েছে : টিআইবি
টিআইবি পরিচালিত ‘বাংলাদেশের অধস্তন আদালত ব্যবস্থা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণায় উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি এ পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে। এই গবেষণা জানুয়ারি-অক্টোবর ২০১৭ সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অধস্তন আদালতের বিচার ব্যবস্থা বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’

গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বিদ্যমান দ্বৈত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিছু ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরিসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘এ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদনে বড় অন্তরায় হিসেবে অধস্তন আদালতগুলোর সার্বিক কার্য পরিবেশকে প্রভাবিত করছে।’

তিনি বলেন, গবেষণার পর্যবেক্ষণে অধস্তন আদালত ব্যবস্থায় অবকাঠামো, লজিস্টিকস, বাজেট, জনবল ও প্রশিক্ষণ, কার্যকর জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি উৎকন্ঠাজনক ও বিব্রতকর। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচারে অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে অধস্তন আদালতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ যেমন মামলার দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি ইত্যাদি মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অধস্তন আদালত ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও অবকাঠামো, লজিস্টিকস, বাজেট, জনবল, প্রশিক্ষণ ও কার্যকর জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি; মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থের লেনদেনসহ নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে অধস্তন আদালতব্যবস্থায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।

গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়গুলো আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যা কিছু ক্ষেত্রে অধস্তন আদালতব্যবস্থার কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে। এটা বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে ১০৯, ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। এই দ্বৈত প্রতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতি ও টানাপোড়েনের কারণে কিছু ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ বা দীর্ঘসূত্রতা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় ঘাটতির সৃষ্টি করেছে।

এছাড়া, কর্মচারীদের জন্য পৃথক আচরণবিধি না থাকা, বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অধস্তন আদালতসমূহের অংশগ্রহণের বিধান না থাকাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
গবেষণার আওতাভুক্ত জেলাসমূহের অধস্তন আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব; বদলি, অবসর গ্রহণ, ছুটি ইত্যাদি কারণে কিছু পদ সাময়িকভাবে দীর্ঘদিন শূন্য থাকা; ৬২১টি আদালতে ১১৪ জন বিচারকের সাময়িক ঘাটতি এবং ৫৭৯ জন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য; লিগ্যাল এইড অফিসে পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি ও অনেক ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড অফিসারের অনুপস্থিতির কারণে সেবা প্রদান কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী বিচারক ও কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা; কিছু ক্ষেত্রে কর্মচারী নিয়োগে পদ অনুযায়ী দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ না দেওয়া; কর্মচারীদের নিয়মিত বদলি না হওয়া; রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। গবেষণা চলাকালীন অধস্তন আদালতসমূহে অভিযোগ প্রদানের জন্য কোনো অভিযোগ বাক্স বা কোনো অভিযোগ কেন্দ্র পরিলক্ষিত না হওয়া; নির্ধারিত কোনো ফর্ম ও অভিযোগ গ্রহণের রেজিস্ট্রার না থাকা, অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচারণা; কিছু ক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করতে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, একটি মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূতঅর্থ প্রদান করতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মামলার ধরণ, গুরুত্ব, বিবাদী বা আসামির সংখ্যা, কাজের অত্যাবশ্যকীয়তা, বিচারপ্রার্থীর সামর্থ্য ও এলাকার ওপর নির্ভর করে সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সাক্ষির শুনানি, স্বাক্ষর করা, জেরার সময় যথাযথ ভূমিকা না রাখা, মামলা আপোষ বা প্রত্যাহার করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর ঘুষবা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ আদায়; ওয়ারেন্ট কপি থানায় পাঠানো, ওকালতনামা সনাক্ত,বিভিন্ন নথি উত্তোলণ, আসামিকে খাবার বা কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য কোর্ট পুলিশের অর্থ আদায়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। তবে অবৈধ লেনদেনের এই চিত্র সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োজ্য নয় বলেও উল্লেখ করা হয়।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, অধস্তন আদালত ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা জজ আদালত ভবন নির্মাণ ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে প্রকল্পগ্রহণ; কেস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন; সকল জেলার আদালতের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি; ডিজিটাল পদ্ধতিতে মামলার শুনানি ধারণ ও সংরক্ষণ; ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ;বিচারিক কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তি ব্যবস্থা চালু; জাতীয় হেল্পলাইন স্থাপন এবং আদালত প্রাঙ্গণে আইনগত সহায়তার তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন; কয়েকটি জেলার আদালত ভবনে মাতৃদুগ্ধ পান কক্ষের ব্যবস্থা, আদালত কক্ষের বাইরে বসার ব্যবস্থা, কক্ষ নির্দেশিকা টাঙ্গানো, মামলার তালিকা টাঙ্গানো এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহ গৃহীত হয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে অধস্তন আদালতসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করণে ১৮ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়।

সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত; প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও পুরোনো আইনের সংস্কার; যথাযথভাবে চাহিদা নিরূপণ সাপেক্ষে অধস্তন আদালতগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত; অধস্তন আদালতসমূহের জন্য পর্যাপ্ত জনবল, অবকাঠামো, লজিস্টিকসও আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত; আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা; বিচারকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর; অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মচারীদেরনিয়োগ স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত; রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীদের নিয়োগ স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত; বিচারক এবং কর্মচারী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেপ্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment